মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ - ১৮:২২
গাজায় ট্রাম্পের পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও  যুদ্ধাপরাধ: আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা যুক্তি-প্রমাণসহ ব্যাখ্যা করেছেন যে ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের ট্রাম্পের পরিকল্পনা একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আনাদোলু সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ফিলিস্তিনিদের বের করে দিয়ে গাজাকে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে আনার ট্রাম্পের প্রস্তাব, ১৯৪৮ সাল থেকে চলে আসা জোরপূর্বক স্থানান্তরের একটি পদ্ধতিগত ষড়যন্ত্রমূলজ নীতির ধারাবাহিকতা। জেনেভা কনভেনশন এবং রোম সংবিধি অনুযায়ী, এটি একটি যুদ্ধাপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়।

ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার রয়েছে

জন কুইগলি- যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক, বলেছেন যে গাজার বেশিরভাগ বাসিন্দা সেই ফিলিস্তিনিদের বংশধর যারা ১৯৪৮ সালে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল এবং তাই তাদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার রয়েছে। 

তিনি বলেছেন, “গাজার মানুষ একটি অপেক্ষাকৃত অদ্ভুত আইনি অবস্থানে রয়েছে। তাদের বেশিরভাগই সেই পরিবার থেকে এসেছেন যারা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের তাদের আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। এই জনসংখ্যাই গাজার প্রধান অংশ গঠন করে।”

এই অধ্যাপক জোর দিয়ে বলেছেন, “এই লোকদের ফিলিস্তিনের তাদের আবাসস্থলে ফিরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই অঞ্চলগুলি ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল দখল করে আছে।” 

কুইগলি ট্রাম্পের প্রস্তাবকে স্পষ্টভাবে অবৈধ বলে উল্লেখ করেছেন এবং যোগ করেছেন, “ফিলিস্তিনিদের সম্মতি ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের গাজার ভূমিতে প্রবেশের এই পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে অবৈধ হবে। এই ভূমি তাদের এবং তাদেরই এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে যে কে এই ভূমিতে প্রবেশ করবে। ইউরোপের কোনো দেশই তাদের ভূমির কোনো অংশ সম্মতি ছাড়াই কোনো বিদেশী শক্তির কাছে হস্তান্তর করতে পারে না। এবং এটাই ঠিক ট্রাম্প যা প্রস্তাব করছেন।”

তিনি আরও দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, “ইসরায়েলি মন্ত্রীদের কাছ থেকে আগেও একই ধরনের বক্তব্য শোনা গেছে; এটি আশ্চর্যজনক যে একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার পর বলা হয় যে এই অবস্থার সমাধান হলো সেই অঞ্চলের সমস্ত মানুষকে উচ্ছেদ করা। সুতরাং, ট্রাম্প স্বীকার নাও করতে পারেন যে গণহত্যা হয়েছে, কিন্তু এটি একটি বাস্তবতা।” 

কুইগলি বলেছেন, “যখন গণহত্যা সংঘটিত হয়, তখন যতটা সম্ভব ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব থাকে এবং মানুষকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা নিশ্চিতভাবে এর সমাধান নয়। এটি তাদের অধিকারের আরও লঙ্ঘন।”

জোরপূর্বক স্থানান্তর নিজেই একটি যুদ্ধাপরাধ 

সুসান এম. আকরাম- যিনি বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুলের আইন বিভাগের অধ্যাপক, বলেছেন যে ট্রাম্পের প্রস্তাব বেশ কয়েকটি আইনি ধারা লঙ্ঘন করে। 

তিনি বলেছেন, “জোরপূর্বক স্থানান্তর নিজেই জেনেভা কনভেনশনের চতুর্থ ধারা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধির অধীনে একটি যুদ্ধাপরাধ; জেনেভা কনভেনশনের চতুর্থ ধারার ৪৫ এবং ৪৯ ধারা জোরপূর্বক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্থানান্তর এবং দখলকৃত অঞ্চল থেকে নির্বাসন নিষিদ্ধ করে।”

তিনি বলেছেন, “জেনেভা কনভেনশনের ১৪৭ ধারা, সংরক্ষিত ব্যক্তিদের (সব বেসামরিক এবং যারা যুদ্ধে সক্রিয় নয় এবং দখলকৃত জনগণ) অবৈধ নির্বাসন বা স্থানান্তরকে গুরুতর লঙ্ঘন হিসাবে বিবেচনা করে। গুরুতর লঙ্ঘন একটি যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার অংশ হিসাবেও বিবেচিত হয়।”

জাতিগত শুদ্ধিকরণও একটি যুদ্ধাপরাধ

আকরাম যোগ করেছেন যে রোম সংবিধি স্পষ্টভাবে বেসামরিক লোকদের স্থানান্তরকে যুদ্ধাপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে। 
এই আমেরিকান অধ্যাপক আরও বলেছেন, “রোম সংবিধির ৮ ধারা স্পষ্টভাবে বেসামরিক লোকদের স্থানান্তরের যুদ্ধাপরাধের উপাদানগুলি নির্দিষ্ট করে এবং রোম সংবিধির ৭ ধারা জোরপূর্বক স্থানান্তর বা নির্বাসনকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অংশ হিসাবে বিবেচনা করে।”

তিনি আন্তর্জাতিক আইনে আমেরিকার আইনি দায়িত্বের কথাও উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, “গণহত্যার সাথে সহযোগিতা একটি পৃথক অপরাধ এবং গণহত্যা কনভেনশনের অধীনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লঙ্ঘন।”

১৯৪৮ সাল থেকে একটি পদ্ধতিগত নীতি

নাজমা আলী জোর দিয়ে বলেছেন যে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারা গাজায় ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক স্থানান্তরের জন্য ট্রাম্পের প্রস্তাবকে সমর্থন করা থেকে বিরত হননি, কারণ এই প্রস্তাব ইসরায়েলি মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের পূর্ববর্তী বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যারা বিশেষ করে যুদ্ধের শুরুতেই কোনো নৈতিক বা আইনি সীমাবদ্ধতা ছাড়াই গাজা খালি করে ইহুদি বসতি স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। 

আলী আরও যোগ করেছেন যে, “জাতিগত শুদ্ধি” এবং ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে অপসারণ সংক্রান্ত বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে এই পদক্ষেপগুলি কোনো দুর্ঘটনাজনিত নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর নীতির অংশ। 

তিনি বলেছেন, ”এটি এখনও একটি বৃহত্তর প্রকল্পের অংশ হতে পারে, যা ট্রাম্পের 'উন্নতি' এবং 'মানবিক ইস্যু' এর প্রস্তাবনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ এবং গাজায় ইচ্ছাকৃতভাবে বসবাসের অযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে গণহত্যার অভিপ্রায়ের প্রমাণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।”

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ট্রাম্প জর্ডান ও মিশরের বিরোধিতাকে তুচ্ছ করে তাদের মার্কিন সাহায্য বন্ধ করার হুমকি দিয়েছেন।

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha